বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিধারা।

১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের সময় বাংলাদেশ উত্তরাধিকার সূত্রে একটি অনুন্নত অর্থনৈতিক কাঠামো লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের ৪৮ বছর পর বাংলাদেশে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। বিগত ৪৮ বছরে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, কৃষি ও শিল্প খাতে অগ্রগতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অর্জিত সাফল্য, মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, পরিবহন ও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সহ অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক গতিধারা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো।


বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিধারা।


১) কৃষি:- কৃষি প্রধান দেশ হওয়া সত্বেও বাংলাদেশ কৃষিতে অনুন্নত। কৃষির উৎপাদনশীলতা যেমন কম তেমনি দেশে ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি বিদ্যমান। তবে সাম্প্রতিককালে বাজেটে কৃষি খাতে অধিক বরাদ্দ, সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, জলবদ্ধতা নিরসন, উন্নত মানের সার ও বীজ সরবরাহ প্রভৃতি কার্যক্রম গ্রহণের ফলে খাদ্য উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬-২০১৭ সালে দেশে খাদ্য উৎপাদন ৩৮৬.৩৪ লক্ষ্য মে. টনে উন্নীত হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪০৭.১৪ লক্ষ মে. টন।

২) শিল্প:- স্বাধীনতা লাভের সময় বাংলাদেশ শিল্পক্ষেত্রে খুবই পিছিয়ে ছিল। কিন্তু সরকার যুগোপযোগী শিল্পনীতি গ্রহণের ফলে দেশে শিল্পে দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। ২০১৭-১৮ সালের জিডিপিতে শিল্পের অবদান বৃদ্ধি পেয়ে শতকরা ১১.৯৯ ভাগে উন্নীত হয়েছে। দ্রুত শিল্পায়নের ফলে দেশে অর্থনৈতিক কাঠামোগত রূপান্তরিত হয়েছে।

৩) জিডিপি প্রবৃদ্ধি:- বৈশ্বিক মন্দ সত্ত্বেও বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক। গত তিন বছরে বাংলাদেশে গড়ে ৬ শতাংশের‌ও বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে। ২০০৯-১০ সালে ৬.০৭ শতাংশ, ২০১০-১১ সালে ৬.৭১ শতাংশ এবং ২০১১-১২ সালে ৬.৩২ শতাংশ প্রভৃতি অর্জিত হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে জিডিপির প্রবৃত্তি ৭.০৫ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। ২০১৭-১৮ সালে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৭.৬৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

৪) মাথাপিছু আয়:- সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। ২০০৫-০৬ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৪৭৬ ডলার। ২০১০-১১ সালে বাংলাদেশি মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৮১৬ বলার এবং ২০১১-১২ সালে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ৮৪৮ মার্কিন ডলার উন্নীত হয়। ২০১২-১৩ সালে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ১,০৪৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১,৭৫২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

৫) দারিদ্র বিমোচন:- দারিদ্র বিমোচনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। দরিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের ফলে বাংলাদেশে দারিদ্র্য মাত্র উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। ২০০৫ সালে দরিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা ছিল ৪০.৪ শতাংশ। ২০১৫ সালে দারিদ্র সীমা নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা ২৪.৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৬ সালে সর্বশেষ খানা আয় ব্যয় জরিপ অনুযায়ী দেশে বর্তমান দারিদ্র্যের হার ২৪.৩ শতাংশ। দুই হাজার কুড়ি সালের মধ্য দারিদ্র্যের হার ১৮.৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে।


Read More :- আত্মকর্মসংস্থান কী এবং দেশের অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব।


৬) বিদ্যুৎ ও জ্বালানি:- বর্তমান সভ্যতার অন্যতম চালিকা শক্তি হলো বিদ্যুৎ। দেশে অর্থ সামাজিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রা মান উন্নয়নে বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক জ্বালানির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি, শিল্প, পরিবহন এবং যোগাযোগ ও গৃহস্থলীর কাজে বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাস প্রভৃতি ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। গ্রামীন অর্থনীতিতেও এ সকল উপাদানের চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে দেশে মোট চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ সুবিধা প্রাপ্ত এখনো পর্যন্ত নয়। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে সরকার বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়নের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে যেমন - পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ, রেন্টাল পাওয়ার প্রডিউস ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্লান্ট প্রভৃতি মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে।

৭) শিক্ষা ও প্রযুক্তি:- সরকার সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করুন এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারিগরি, মাদ্রাসা ও উচ্চ শিক্ষার সম্প্রসনে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে সর্বোচ্চ আর্থিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে ক্রমশ একটি প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। দেশে সাক্ষরতা আর শতকরা ৫৭ দশমিক ৯ ভাগে উন্নীত হয়েছে। নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটি য়ে নারীদের ক্ষমতায়ন ও আহত সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ৬৫,৪৪৪ কটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।


Read More :- রপ্তানিমুখী শিল্প এবং এর গুরুত্ব।


৮) মুদ্রাস্ফীতি:- ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জোনে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৫.৪৪ শতাংশ। এ সময় মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য পণ্যের উচ্চমূল্য, কোন উৎপাদনশীল খাতে অতিরিক্ত ঋণের প্রবাহ মুদ্রাস্ফীতিতে ভূমিকা রেখেছে। চলতি অর্থ বছরে প্রথমার্ধে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি পরিমিত অবস্থান, জোরালো আমদানি প্রবৃত্তি এবং বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃত্তিতে উর্ধ্বমুখী ধরা বজায় রয়েছে। মূলত খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শেষে দাঁড়িয়েছে ৫.৬৩ শতাংশ। তবে নি ট বৈদেশিক সম্পদ এর ঋণাত্মক প্রভৃতি এবং ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের নিম্নমুখী দ্বারা রিজার্ভ মুদ্রার প্রবৃদ্ধি পরিমিত রেখে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে মুদ্রাস্ফীতির চাপ প্রশমনে সহায়তা করতে পারে। 

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। বাংলাদেশের আয়তন অনুযায়ী জনসংখ্যা অত্যাধিক সুতরাং এর জন্য বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং প্রকৃতির উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা একটি অত্যন্ত জনবহুল এবং পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহর গুলোর মধ্যে একটি। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রচুর পরিমাণে বিকাশ লাভ করেছে। যার ফলে দারিদ্রতা অনেকাংশে দূর হয়েছে। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়েছিল তখন দেশটির ৯৫ ভাগ মানুষই দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করত কিন্তু এখন সেই সংখ্যাটি নেমে ২৫ ভাগ মানুষের এসেছে। বিভিন্ন সমস্যা থাকা সত্ত্বেও গত ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতি ভালোই বিকাশ লাভ করেছে। বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি এভারেজ ৬% হারে প্রতিবছর প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে যেটি একটি দেশের অর্থনীতির জন্য সুসংবাদ। এবং এই হারে বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে যেতে থাকলে পরবর্তী ২৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি মোটামুটি শক্ত অবস্থানে এসে দাঁড়াবে। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃত্তি ভালো হলেও এর কিছু সমস্যা রয়েছে যেমন বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি সেক্টরের উপর অত্যাধিক নির্ভরশীল এটি হলো গার্মেন্টস সেক্টর। বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানি করে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। কিন্তু বাংলাদেশ এই পোশাক রপ্তানি খাতে প্রচুর পরিমাণ নির্ভরশীল। একটি খাতের উপর অধিক নির্ভরশীলতার জন্য  অর্থনীতিতে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয় সুতরাং সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে দেশের অর্থনীতি যেন অধিকাংশভাবে একটি খাতের উপর নির্ভরশীল না হয়। দেশের অন্যান্য রপ্তানিযোগ্য খাত গুলোর উপর সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে তাহলে ভবিষ্যতে এই সকল খাত থেকেও রপ্তানি করেও প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে।

Post a Comment

0 Comments