পৃথিবীর কোন দেশে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তবে অধিকাংশ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের রপ্তানি আয় কম অথচ চলতি আমদানি ব্যয় বেশি। অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও সঞ্চয় বিনিয়োগ এবং আমদানি রপ্তানি অপরিহার্য হয়ে পড়ায় জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধির প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু দেশে জাতীয় আয়ের উৎস থেকে অর্জিত অর্থ দ্বারা অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করা প্রায় অসম্ভব। তাই উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্যে প্রয়োজন দেখা দেয়। বিশেষ সুবিধা প্রদান সাপেক্ষে এক দেশ থেকে ওপর দেশে সম্পদ হস্তান্তরকে বৈদেশিক সাহায্য বলে। ব্যাপক অর্থে বৈদেশিক সাহায্য বলতে একটি দেশের জরুরি প্রয়োজন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খাদ্য, ওষুধ, প্রকল্প, দান, অনুদান, ঋণ, আর্থিক ও কারিগরি যে কোনো ধরনের দেশ বহির্ভূত সহায়তা গ্রহণ ও প্রদান উভয়কে বোঝায়।
উন্নয়নশীল দেশে বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্যে তুলনামূলক সুবিধা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বৈদেশিক সাহায্যের তুলনায় বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর অধিক নির্ভর করে নিরাপদ এবং শ্রেয়। বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্যের তুলনামূলক সুবিধা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:-
১) অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের উৎস হিসেবে বৈদেশিক সাহায্য অপেক্ষা বৈদেশিক বাণিজ্য অধিকতর বাঞ্ছনীয়। বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের মধ্যে যেসব বিপদের অসংখ্য থাকে সেগুলো বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে সহজেই এড়ানো সম্ভব। এজন্য বর্তমান কালে বৈদেশিক সাহায্যে অপেক্ষা বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীলতা প্রবণতা ক্রমশের বৃদ্ধি পাচ্ছে। সকল দেশেরই বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা ক্রমশ হ্রাস করে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর অধিক নির্ভরশীল হওয়া উচিত।
২) বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করা যায়। বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ বিশেষ করে রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যেতে পারে। কিভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অর্থসংস্থান করা সম্ভব। এর ফলে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে।
Read More :- বৈদেশিক সাহায্য এবং এর অসুবিধা গুলো কি কি?
৩) বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সাহায্যে কোন দেশ স্বাধীনভাবে বাঁচাচ্ছে যাচাই করে বিভিন্ন দেশ হতে সস্তায় উন্নত মানের দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় করতে পারবে।
৪) বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে কোন দেশে প্রাকৃতিক সম্পদে পণ্য সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। বিভিন্ন দেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। এসব প্রাকৃতিক সম্পদে যথাযথ ব্যবহারে উৎপাদিত দ্রব্য সামগ্রী বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
৫) বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল হলে প্রত্যেক দেশ স্বাধীনভাবে নিজের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রমাণ করতে পারে। বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করলে সাধারণত সাহায্য দান কারী দেশের ইচ্ছা ও নির্দেশ অনুযায়ী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। এর ফলে অনেক সময় জাতীয় শর্ত বিপন্ন হয়। কিন্তু প্রত্যেক দেশ বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে উচিত বৈদেশিক মুদ্রা স্বাধীনভাবে খরচ করতে পারে। এজন্য বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল দেশসমূহ জাতীয় সত্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রদান করতে পারে।
৬) বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে। প্রত্যেক দেশ প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ সদ্ব্যবহার মাধ্যমে তার রপ্তানি পণ্য সামগ্রীর উৎপাদন বাড়াতে সচেষ্ট হয়। এর ফলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীলতার মনোভাব গড়ে ওঠে এবং দেশ দ্রুত স্বনির্ভরতা দিকে এগিয়ে যায়।
Read More :- সরকারি ঋণ এবং সরকারি ঋণের উদ্দেশ্য কি?
নিচে বৈদেশিক সাহায্যের কিছু সুবিধা নিয়ে আলোচনা করা হলো:-
স্বল্পোন্নত দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক সাহায্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাসে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় সব দেশে কিছু না কিছু বিদেশি সাহায্য গ্রহণ করে থাকে। অনুন্নত দেশসমূহের অধিকাংশ লোক দারিদ্র এবং তাদের মাথাপিছু আয় খুবই কম। ফলে তাদের সঞ্চয় এর পরিমাণও অত্যন্ত কম। এ কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয় তা কেবল অভ্যন্তরীণীয় উৎস হতে সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। এ এ অবস্থায় অনুন্নত দেশ সমূহকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যয় নির্বাহের জন্য বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়। তবে বৈদেশিক সাহায্যের উপর অত্যাধিক নির্ভরশীলতা মোটেই কাম্য নয়। কারণ বৈদেশিক সাহায্যের সুবিধা অপেক্ষা অসুবিধা অনেক বেশি। বৈদেশিক সাহায্যের অসুবিধাগুলো নিয়ে পরবর্তী একটি পোস্টে আলোচনা করা হবে।
বৈদেশিক সাহায্য একটি দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো প্রাথমিক পর্যায়ে ভালো হয় না আর এই অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে উন্নত করার জন্য প্রচুর পরিমাণ অর্থের দরকার হয় কিন্তু একটি অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের কাছে এত পরিমাণ অর্থ থাকে না সেজন্য অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো বৈদেশিক সাহায্য পেলে এই অর্থে মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বা মজবুত অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়তে এই অর্থ ব্যয় করা হয় যার ফলে ধীরে ধীরে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হয় এবং দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হলে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। সুতরাং বৈদেশিক সাহায্যের গুরুত্ব অপরিসীম। বৈদেশিক সাহায্য প্রধানত দুই ভাবে পাওয়া যায় প্রথমত বিভিন্ন দেশের সরকারের থেকে এবং দ্বিতীয়ত আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা থেকে যেমন বিশ্বব্যাংক বা আই-এম-এফ। এই দুই মাধ্যমেই মূলত বেশিরভাগ দেশ অর্থ সাহায্য নিয়ে থাকে এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পতে সেটি ব্যয় করে থাকে। তবে বৈদেশিক সাহায্য নেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, যে কারণে বৈদেশিক সাহায্যটি নেয়া হচ্ছে সেই প্রকল্পতেই যেন সঠিকভাবে অর্থগুলো ব্যয় করা হয়। দুর্নীতি বা অন্য কোন কারণে বিদেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে নেওয়া অর্থগুলি যদি সঠিক প্রকল্পে ব্যয় না করা হয় তাহলে সেটি দেশের অর্থনীতিতে তেমন কোন প্রভাব ফেলবে না বরং বিদেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থান থেকে নেওয়া এই অর্থ গুলি ঋণ হিসেবে দেশের উপর আরো চাপ বাড়াবে। সুতরাং সরকারকে এটি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে বৈদেশিক সাহায্যের অর্থগুলো যেন সঠিক প্রকল্পে সঠিকভাবে ব্যয় করা হয় তাহলেই সেটি আমাদের দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
0 Comments