সরকারি ঋণ এবং সরকারি ঋণের উদ্দেশ্য কি?

সরকারি ঋণ বলতে সরকার বা রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত ঋণ কে বোঝায়, অনেক সময় ব্যক্তির ন্যায় সরকারকেও ঋণ গ্রহণ করতে হয়। সরকারের রাজস্ব আয় থেকে ব্যয় নির্বাহ করা না গেলে সরকার ঋণের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য জরুরি অবস্থা মোকাবেলা, যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। এ ব্যয়ের পরিমাণ যদি সরকারের অপেক্ষা বেশি হয় তাহলে সরকারকে ঋণ গ্রহণ করে এ ঘাটতি পূরণ করতে হয়, সরকার যখন ঋণপত্র বিক্রি করে কিংবা অন্য কোন উপায়ে দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকে তাকে সরকারি ঋণ বলে। বর্তমানে সরকার দেশের অভ্যন্তরে জনসাধারণ, ব্যাংক অথবা অন্য কোন দেশের সরকার, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, বিশ্ব ব্যাংক প্রভৃতি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকে।


সরকারি ঋণ এবং সরকারি ঋণের উদ্দেশ্য কি?


সরকার যখন চিরাচরিত রাজস্ব উৎস হতে সংগৃহীত অর্থ ধারা ব্যয় সংকলন করতে পারে না তখন অভ্যন্তরণীয় ও বৈদেশিক উৎস হতে ঋণ সংগ্রহ করে। সরকারি ঋণের প্রধান উদ্দেশ্য গুলো নিম্নরূপ:-


১) অপ্রত্যাশিত জরুরি অবস্থা মোকাবেলা:- সরকারি ঋণের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল দেশের অপ্রত্যাশিত জরুরি অবস্থার মোকাবেলা করা। অনেক সময় দেশে অপ্রত্যাশিতভাবে খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, মহামারী, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি দেখা দিতে পারে। এ ধরনের জরুরি অবস্থা মোকাবেলার জন্য সরকারের প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয় যা সরকারের স্বাভাবিক রাজস্ব উৎস হতে মেটানো সম্ভব হয় না। এ ধরনের অপ্রত্যাশিত জরুরি অবস্থা মোকাবেলার জন্য সরকার ঋণ গ্রহণ করে থাকে।

২) বাজেট ঘাটতি পূরণ:- অনেক সময় মন্দ বা অন্য কোন অপ্রত্যাশিত কারণে সরকারের আয় অপেক্ষা ব্যয় বেশি হয়। এর ফলে সরকারের জাতীয় বাজেটে ঘাটতি দেখা যায়। এ ধরনের বাজে ট ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার ঋণ গ্রহণ করে থাকে।


Read More :- একটি দেশের অর্থনীতিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব।


৩) বাণিজ্য চক্র নিয়ন্ত্রণ:- সরকারি ঋণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বাণিজ্য চক্র নিয়ন্ত্রণ। বাণিজ্য চক্রের মন্দার সময় দেশে বিনিয়োগ স্বল্পতা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে সরকার ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক মন্দ দূর করার চেষ্টা করে। সুতরাং বাণিজ্য চক্র নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সরকার ঋণ গ্রহণ করে।

৪) মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ:- মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ও সরকার ঋণ গ্রহণ করে থাকে। মুদ্রাস্ফীতির সময় সরকার কর বৃদ্ধি পাশাপাশি দেশের ভিতরের জনগনের কাছ থেকে সরকারি ঋণ গ্রহণ করে সমাজের মোট ব্যয় প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি কমে আসতে পারে। অধ্যাপক এ. পি . লারনার, পি. এ. স্যামুয়েলসন প্রমূখ অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, করের পরিপূরক হিসাবে সরকারি ঋণ রাজস্ব নীতির একটি মস্ত বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। তাই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য সরকার ঋণ গ্রহণ করতে পারে।

৫) সামাজিক কল্যাণ:- বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। জনকল্যাণী সরকারের মুখ্য দায়িত্ব। স্কুল কলেজ, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল নির্মাণ ইত্যাদি হলো সামাজিক কল্যাণের মূল ভিত্তি। এ সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। শুধু কর রাজস্বের মাধ্যমে এই বিপুল পরিমাণ ব্যায় মিটানো সম্ভব না। তাই সামাজিক কল্যাণ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সরকার ঋণ গ্রহণ করতে পারে।

৬) বেসরকারি সঞ্চয় বৃদ্ধি:- সরকার ঋণ গ্রহণ করলে তা দেশে অভ্যন্তরে সঞ্চয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। সরকার ঋণপত্র বিক্রি করে ঋণ সংগ্রহ করলে দেশে লোক তাদের সঞ্চিত অর্থ সরকারি ঋণপত্রে বিনিয়োগ করার সুযোগ পায়। এতে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা উৎসাহিত হয়। এক্ষেত্রে সরকারি ঋণ দেশে সঞ্চয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।

৭) উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন:- সরকারি ঋণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো উন্নয়ন পরিকল্পনা অর্থায়ন। উন্নয়নশীল দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রচুর পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কেবল কর আরোপের মাধ্যমে সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া, উন্নয়নশীল দেশে লোকের কর প্রদানের সামর্থ্য সীমিত। তাই উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়।

৮) যুদ্ধকালীন ব্যয় নির্বাহ:- সরকারি ঋণের অন্যতম উদ্দেশ্য হল যুদ্ধকালীন ব্যয় নির্বাহ। আধুনিককালে যুদ্ধে ব্যয় নির্বাহ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বর্তমানে এক দেশের সাথে অন্য দেশে যুদ্ধ বাঁধলে সংশ্লিষ্ট দেশকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বিপুল পরিমাণে অর্থব্যয় করতে হয়। দেশে বিদ্যমান কর হার বৃদ্ধি করে বা নতুন কোন কর আরোপ করে যুদ্ধের ব্যবহার বহন করা সম্ভব হয় না। তাই যুদ্ধকালীন ব্যয় নির্বাহের উদ্দেশ্যে সরকার ঋণ গ্রহণ করে থাকে।


Read More :- দেশের অর্থনীতিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রভাব।


উপসংহারে বলা যায়, সরকার দেশের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটানোর জন্য ঋণ নিয়ে থাকে যেমন বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, যুদ্ধের ব্যয় বহন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে সরকার ঋণ গ্রহণ করে থাকে এবং এই ঋণ গ্রহণের ফলে যেমন সুবিধা আছে তেমন অসুবিধা আছে। বিদেশি ঋণের উপর বেশি নির্ভরশীল হলে সেটি ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে এই বিষয় নিয়ে অন্য একটি পোস্টে আলোচনা করা হয়েছে।

সরকার মূলত দেশের অর্থের চাহিদা মেটাতেই ঋণ নিয়ে থাকে এবং এই ঋণের উদ্দেশ্য হল দেশের বিভিন্ন সেক্টরসহ দেশের উন্নয়নমূলক প্রজেক্টগুলোকে অর্থায়ন করা। একটি দেশের সরকারকে দেশ চালানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে অর্থের প্রয়োজন হয় কিন্তু রাজস্ব আদায় ও বিভিন্ন উপায়ে সরকার যে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে সেটি দেশ চালানোর জন্য অনেক সময় পর্যাপ্ত হয় না। সুতরাং সরকারকে ঋণের আশ্রয় নিতে হয় এবং জনগণ বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারি ঋণ গ্রহণ করে থাকে এবং এই ঋণের টাকার বিনিময়ে সরকারকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ দিতে হয় আর ঋণের মেয়াদ শেষ হলে সরকারকে সেই অর্থ ফেরত দিতে হয়। সরকারি ঋণের অনেক সুবিধা রয়েছে যেমন, সরকার আর্থিক সংকটে পড়লে তখন বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক প্রকল্প সহ বিভিন্ন খাতের জন্য বরাদ্দ অর্থের সংকট দেখা দেয় ঠিক তখনই সরকার যদি ঋণ গ্রহণ করে তাহলে এই অর্থের সংকট দূরীকরণ করা সম্ভব এতে করে দেশের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি হয় না এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাড়িয়ে তোলা সম্ভব হয়। তবে সরকারি ঋণ গ্রহণের কিছু খারাপ দিক ও আছে তার মধ্যে অন্যতম, সরকার যদি তার সামর্থের চেয়ে অধিক ঋণ গ্রহণ করে থাকে তবে সেই ঋণের সুদসহ ঋণের মেয়াদ শেষ হলে সেটি পরিশোধ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আবার সরকার ঋণ গ্রহণ করার পর যদি সেই অর্থ উৎপাদনশীল খাতে সঠিকভাবে বিনিয়োগ করতে ব্যর্থ হয় তখন এই ঋণ সরকারের কাছে একটি বোঝা হিসেবে দাঁড়ায়। সুতরাং সরকারকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে, সামর্থ্য অনুযায়ী ঋণ গ্রহণ করা এবং সেই ঋণের টাকা যেন উৎপাদনশীল খাত গুলোতে সঠিকভাবে বিনিয়োগ করা হয় তাহলেই এই ঋণ দেশ এবং দেশের জনগণের জন্য সুবিধা বয়ে আনবে এবং দেশের অর্থনৈতিক গতিধারাকে তুরান্ত্রিত করবে।

Post a Comment

0 Comments