মুদ্রাস্ফীতি এবং এর কারণসমূহ।

মুদ্রাস্ফীতি বলতে এমন এক অবস্থা কে বোঝায় যে অবস্থায় মুদ্রার মূল্য কমতে থাকে এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং চাহিদা অনুযায়ী দ্রব্য সামগ্রী পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে। সাধারণত উন্নয়নশীল দেশসমূহে মুদ্রাস্ফীতির প্রকোপ বেশি দেখা যায়। মুদ্রাস্ফীতি অর্থনীতিতে এক বিরাট সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে। কারণ মুদ্রাস্ফীতির ফলে মুদ্রার ক্রয় ক্ষমতার হ্রাস পায়। এর ফলে বাজারে কাঙ্খিত দ্রব্য ক্রয় করতে বেশি পরিমাণ মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। তখন সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ নানাভাবে প্রভাবিত হয়। ব্যবসায়ী শ্রেণির জন্য ভালো হলেও, স্থির আয়ের লোকেরা দামের উর্ধ্বচাপে বেশি কষ্ট পায়।


মুদ্রাস্ফীতি এবং এর কারণসমূহ।


মুদ্রাস্ফীতি একটি জটিল সমস্যা। বিভিন্ন কারণে মুদ্রাস্ফীতি ঘটতে পারে। মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণ গুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো।


১) অর্থের যোগান বৃদ্ধি: মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণ হলো অর্থের যোগান বৃদ্ধি। অর্থের যোগান বৃদ্ধি পেলে লোকের ক্রয় ক্ষমতা এবং দ্রব্য সামগ্রী চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু দ্রব্যের যোগান সেই অনুপাতে বৃদ্ধি না পেলে দাম স্তর বৃদ্ধি পায় এর ফলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।

২) অতিরিক্ত সরকারি ব্যয়: মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত সরকারি ব্যয়। আধুনিককালে প্রত্যেক দেশের সরকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে থাকে। কিন্তু সরকারি ব্যয় যে হারে বৃদ্ধি পায় স্বল্পকালে উৎপাদন সে অনুপাতে বাড়ে না এর ফলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।


Read More: কোন দেশের মুদ্রাস্ফীতি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।


৩) ব্যাংক ঋণের প্রসার: বাণিজ্যিক ব্যাংক অতিরিক্ত ঋণ প্রদানের করলেও দেশে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। অনেক সময় বাণিজ্যিক ব্যাংক সমূহ উদার ও সুলভ ঋণ নীতি অনুসরণ করে তাদের ঋণ প্রদান করে। এভাবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঋণ প্রদানের ফলে দেশে অর্থের যোগান বৃদ্ধি পায় ও মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়।

৪) উৎপাদন হ্রাস: কৃষিজাত ও শিল্প জাত পণ্যের উৎপাদনের স্বল্পতাও মুদ্রাস্ফীতির জন্য দায়ী। বিভিন্ন কারণে অনেক সময় উৎপাদন ব্যাহত হয়। অর্থের যোগান অপরিবর্তিত থেকে উৎপাদন কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই দাম স্তর বৃদ্ধি পায় এবং মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।

৫) ঘাটতি ব্যয়: ঘাটতি ব্যয়ের ফলেও  মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়। অনুন্নত দেশের সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অনেক সময় আয় অপেক্ষা ব্যয় বেশি করে। এ ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার অতিরিক্ত মুদ্রা সৃষ্টি করে। কিন্তু এ বাড়তি মুদ্রার অনুপাতে দ্রব্য সামগ্রীর উৎপাদন বৃদ্ধি পায় না। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়।

৬) অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধি: মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধি। সরকার অনেক সময় অনুৎপাদনশীল খতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে থাকে। শিশু পার্ক, স্টেডিয়াম নির্মাণ প্রভৃতি খাতে ব্যয়বৃদ্ধি করলে জনগণের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে কিন্তু উৎপাদন বাড়ে না। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।

৭) ভোগ ও বিনিয়োগ ব্যয় বৃদ্ধি: মুদ্রাস্ফীতির আরেকটি কারণ হলো ভোগব্যয় ও বিনিয়োগ ব্যয় বৃদ্ধি। সমাজে ভোগব্যয় ও বিনিয়োগ-ব্যয় বৃদ্ধি পেলে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধি ঘটে। কারণ, ভোগব্যয় ও বিনিয়োগ ব্যয় বৃদ্ধির ফলে দেশের সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু স্বল্পকালীন সময়ে সে হারে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় না। এর ফলে অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।

৮) প্রাকৃতিক দুর্যোগ: অনেক সময় অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জ্বলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে কৃষি ও শিল্পর উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে দ্রব্যের উৎপাদন ও যোগান হ্রাস পায়। অর্থের যোগান অপরিবর্তিত থেকে দ্রব্যের যোগান কমে যাওয়ার ফলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।

৯) মজুরি বৃদ্ধি: অনেক সময় শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির ফলেও মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। কারণ, শ্রমিকদের দাবির ফলে মজুরি বাড়ানো হলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। তখন ব্যবসায়ীরা উৎপাদিত দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়।


Read More: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্ব।


১০) চোরাকারবারি ও মজুদদারী: মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হলো চোরাকারবারি ও মজুদদারী। চোরাকারবারিরা অধিক লাভের আশায় দেশীয় উৎপাদিত পণ্য দেশের বাইরে পাচার করে দ্রব্যসামগ্রীর ঘাটতি সৃষ্টি করে। একইভাবে মজুতদাতারা অবৈধভাবে দ্রব্য সামগ্রী মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। এর ফলে দ্রব্য সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি পায় এবং দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।

১১) যুদ্ধজনিত ব্যয় নির্বাহ: মুদ্রাস্ফীতির আরেকটি প্রধান কারণ হলো যুদ্ধজনিত ব্যয়। কোন দেশ যখন যুদ্ধবস্থার সম্মুখীন হয় তখন সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ অর্থের ঋণ গ্রহণ বা ধার্য করে সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় সরকার অতিরিক্ত কাগজি নোট ছাপিয়ে যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। এর ফলে দেশে দ্রব্যমূল্যর দাম বৃদ্ধি পায় এবং মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।


উপসংহার

সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর লোক বসবাস করে। সব শ্রেণীর লোকের উপর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব এক রকম নয়। মুদ্রাস্ফীতির ফলে এক শ্রেণীর লোক যেমন লাভবান হয় তেমনই অন্য এক শ্রেণীর লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুদ্রাস্ফীতির ফলে সমাজের নির্দিষ্ট আয়ের লোকেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রবমূল্য বৃদ্ধির দরুন জীবনযাত্রার ব্যায় বৃদ্ধি পায় ফলে নির্দিষ্ট আয়ের লোকেদের প্রকৃত আয় কমে যায় এবং তারা আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। মুদ্রাস্ফীতির ফলে দেনাদাররা লাভবান হয় কিন্তু পাওনাদারদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। মুদ্রাস্ফীতি অনেক বেশি হলে দেনাদাররা অপেক্ষাকৃত কম দ্রব সামগ্রী বিক্রয় করে'দেন পরিশোধ করতে পারে কিন্তু পাওনাদাররা সমপরিমাণ অর্থ ফেরত পেলেও মুদ্রাস্ফীতির ফলে তার আসল মূল্য কমে যায় ফলে তারা ক্ষতি গ্রস্ত হয়ে থাকে। তবে যারা কৃষি কাজের সাথে নিয়োজিত তারা লাভবান হয়ে থাকে কারণ মুদ্রাস্ফীতির ফলে ফসল উদ্পাদনের খরচ খুব বেশি বৃদ্ধি না পেলেও ফসলের দাম  অনেকটা বৃদ্ধি পায় ফলে কৃষক সেটি  বিক্রয় করে কৃষকগণ লাভবান হতে পারে। অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতির কারণে করদাতাদের সুবিধা হয় কারণ তারা কম পরিমাণ দ্রব্য সামগ্রী বিক্রয় করে কর পরিশোধ করতে পারে আর কর গ্রহীতারা সম পরিমাণ কর পেলেও মুদ্রাস্ফীতির কারণে তার মূল্য কমে যায়। সুতরাং আমরা বুঝতে পারলাম যে মুদ্রাস্ফীতি কিছু শ্রেণীর লোকের জন্য সুফল বয়ে আনে আবার কিছু শ্রেণীর লোকের জন্য কুফল। সেইজন্য মুদ্রাস্ফীতি অতিরিক্ত মাত্রায় যাতে না হয় সেদিকে সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

Post a Comment

0 Comments