মুদ্রাস্ফীতি কোন দেশের অর্থনীতির জন্য একটি জটিল সমস্যা। এটি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তাহলে দেশের জনগণের উপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। উন্নত দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব বেশি না পড়লেও উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোতে এর প্রভাব ব্যাপক। অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতির ফলে একটি দেশের অর্থনীতি ভয়ংকর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এই বিষয়টি সম্পর্কে জানা আমাদের জন্য খুবই জরুরী। নিচে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কিছু উপায় সমূহ নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১) উৎপাদন বৃদ্ধি: মুদ্রাস্ফীতি রোধ করতে হলে সর্বাগ্রে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষি ক্ষেত্রে উৎস ফলনশীল বীজ, সার প্রয়োগ ও পানি সেচের ব্যবস্থা করে কৃষির উৎপাদন বাড়াতে হবে। এভাবে কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী সরবরাহ বৃদ্ধি করে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমানো যেতে পারে।
২) ঘাটতি ব্যয় হ্রাস: মুদ্রাস্ফীতি রোধ করতে হলে ঘাটতি ব্যয় নীতি পরিহার করতে হবে। স্বাধীনতা লাভের পর দেশে ব্যাপক ঘাটতি ব্যয় অনুসরণের ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতি রোধ করতে হলে ঘাটতি ব্যয় যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে।
৩) উদার আমদানি নীতি: মুদ্রাস্ফীতি রোধের জন্য উদার আমদানি নীতির মাধ্যমে বিদেশ হতে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যশস্য এবং পন্য সামগ্রী আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমান দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত দ্রব্য সামগ্রী আমাদের চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। এ কারণে বিদেশ হতে অধিক দ্রব্যসামগ্রী আমদানির মাধ্যমে দেশে মাথাপিছু পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কম হবে।
৪) খাদ্য ঘাটতি হ্রাস: কোন দেশের বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির চাপ ও দ্রব্যমূল্য হ্রাস করতে হলে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ হ্রাস করতে হবে। কারণ, কোন দেশের মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম একটি কারণ হতে পারে খাদ্য ঘাটতি। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতির চাপ রোদ করতে হলে দেশের বর্তমান খাদ্য ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে একদিকে দেশের অভ্যন্তরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে এবং অন্যদিকে বিদেশ হতেও পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। এর ফলে খাদ্যশস্যের মূল্য এবং অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে।
৫) উৎপাদন খরচ হ্রাস: মুদ্রাস্ফীতির চাপ এবং দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য হ্রাস করতে হলে দ্রব্য সামগ্রীর উৎপাদন খরচ যথাসম্ভব কমাতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন, পর্যাপ্ত কাঁচামাল সরবরাহ, শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পরিচালনা ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমানো যেতে পারে। যুব সামগ্রী উৎপাদন খরচ কম হলে তাদের দামও কম হবে এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপ হ্রাস পাবে।
Read More: মুদ্রাস্ফীতি এবং এর কারণসমূহ।
৬) মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও রেশনিং ব্যবস্থার প্রবর্তন: মুদ্রাস্ফীতি চাপ এবং দ্রব্যমূল্যে উদ্যগতিরোধের জন্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং রেশনিং পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। যে সমস্ত দ্রব্য জীবন ধারণের জন্য আবশ্যক যেমন - চাল, গম, চিনি, কাপড়, কেরোসিন তেল প্রভৃতি দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। তাছাড়া, রেশনিং পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে ন্যায্য মূল্যে এসব নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সুষ্ঠু বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে।
৭) পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন: মুদ্রাস্ফীতি রোধ করতে হলে দেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করতে হবে। পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হলে দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রব্য সামগ্রী দ্রুত স্থানান্তর করা যায়। সুতরাং পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হলে দেশের বিভিন্ন স্থানে দ্রব্য সামগ্রী দ্রুত চলাচলের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ করা সম্ভব হবে।
৮) অধিক সঞ্চয়ে উৎসাহ প্রদান: মুদ্রাস্ফীতি রোধের জন্য জনসাধারণকে অধিক সঞ্চয়ে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। কারণ, সঞ্চার পরিমান বৃদ্ধি পেলে সমাজে ব্যয়পোযোগী অর্থের যোগান কমে যায় যার ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কিছুটাও হ্রাস পায়।
৯) আর্থিক ব্যবস্থা গ্রহণ: মুদ্রাস্ফীতি রোধের জন্য সরকারকে বিভিন্ন আর্থিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেশের অর্থের যোগান হ্রাস করতে হবে এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক সৃষ্ট ব্যাংক ঋণের এর পরিমাণ কমাতে হবে। ব্যাংক হার বৃদ্ধি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিসার্ভের হার বৃদ্ধি, খোলা বাজারের ঋণপত্র বিক্রয় এবং অন্যান্য আর্থিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমানো যেতে পারে।
Read More: বিশ্বায়ন কি এবং বিশ্বায়নের কিছু বৈশিষ্ট্য।
১০) রাজস্ব ব্যবস্থা: মুদ্রাস্ফীতি চাপ মোকাবিলার জন্য সরকারকে আর্থিক নীতির পাশাপাশি সুষ্ঠু রাজস্ব নীতি অনুসরণ করতে হবে। বর্তমানে সরকার পরোক্ষ করের উপর অধিক নির্ভরশীল। পরোক্ষ করের হয় বৃদ্ধি করলে দেশে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পায়। তাই মুদ্রার স্মৃতিরোধের জন্য সরকারকে পরোক্ষ করে হার হ্রাস করতে হবে এবং অধিক হারে প্রত্যক্ষ কর ধার্য করতে হবে।
১১) দ্রুত উদপাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ: মুদ্রাস্ফীতির চাপ রোধে সরকারকে দ্রুত সরকারকে দ্রুত উদ্পাদনক্ষম প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হবে। যে সব ক্ষেত্রে তারাতারি উদপাদন করা সম্ভব যে সব ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগ করা হলে দ্রব সামগ্রীর উদপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ হ্রাস পাবে।
১২) প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্থিক নীতি ও রাজস্ব নীতির প্রয়োগ ছাড়াও সরকার কিছু প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এগুলোকে প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বলে হয়। প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলো নিন্মরূপ :-
ক) সর্বোচ্চ দাম নিধারণ: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার পণ্যসামগ্রীর দামের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিতে পারে। এইভাবে পণ্যসামগ্রীর সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য বেঁধে দেওয়া হলে দামস্তর একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়।
খ) ন্যায্য মূল্যের বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ন্যায্য মূল্যে ভোগ্য পণ্য সরবরাহের জন্য সরকার ন্যায্য মূল্যের বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করতে পারে। এছাড়া সরকার রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে পারে। এর ফলে দামস্থার হ্রাস পাবে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের রাখা সম্ভব হবে।
গ) মজুরি নিয়ন্ত্রণ: মুদ্রাস্ফীতির সময় শ্রমিকগণ মজুরির হার বাড়ানোর জন্য যা প্রয়োগ করে। তাদের অধিক মজুরি দেওয়ার ফলে উৎপাদন ব্যয় এবং মূল্যস্তর বেড়ে যায়। তখন ছবিটা পুনরায় মজুরি বৃদ্ধির দাবি করে। এ রূপে ক্রমাগতভাবে মূল্যস্তর ও মজুরি বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেজন্য অনেক সময় আইন করে বা আপসের মাধ্যমে মজুরি নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
ঘ) মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও রেশনিং ব্যবস্থা: অধ্যাবস্যক দ্রব্যাদির মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও রেশনিং ব্যবস্থা চালু করে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কিছুটা কমানো যেতে পারে।
ঙ) গচ্ছিত অর্থ আটক: মুদ্রাস্ফীতির সময় জনসাধারণ বিশেষ করে ধনী ব্যক্তিরা যাতে বেশি অর্থ ব্যয় করতে না পারি সেজন্য অনেক সময় সরকার তাদের ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের সম্পূর্ণ বা কিছু অংশ সাময়িকভাবে আটক করে রাখে। এর ফলে এই অংশ ব্যয় করা সম্ভব হয়না। ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমে।
উপসংহার: মুদ্রাস্ফীতি নিঃসন্দেহে একটি জটিল ও গুরুতর সমস্যা। কোন একটি বিশেষ পদ্ধতির সাহায্যে তা দূর করা সম্ভব নয়। এজন্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আর্থিক নীতির পাশাপাশি রাজস্ব নীতির প্রয়োগ সহ বিভিন্ন প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
0 Comments