বিশ্বায়নবাদিদের তাত্তিক আলোচনায় বিশ্বায়ন সম্পর্কে যত ভালো কথাই বলা হোক না কেন বিশ্বায়নের বাস্তব চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। বিশ্বায়ন বিরোধীদের মতে, বিশ্বায়ন হলো পুঁজিবাদেরই একটি বিশেষ রূপ। তৃতীয় বিশ্বের কাছে বিশ্বায়ন এক ভোগ বাদী ও অগ্রসি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো আজ বিশ্বায়ন আতঙ্কে ভুগছে। বিশ্বায়নের বিপক্ষে যুক্তি সমূহ বা বিশ্বায়নের অসুবিধা গুলো নিচে আলোচনা করা হলো।
১) অর্থনৈতিক শোষণ:- বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় অনুন্নত দেশসমূহ উন্নত দেশের শোষণের শিকারে পরিণত হচ্ছে। উন্নত কলাকৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত দেশগুলোর যেসব পূর্ণ সামগ্রী উৎপাদন করে তার সাথে প্রতিযোগিতায় অনুন্নত দেশসমূহ টিকে থাকতে পারছে না। ফলে অনুন্নত দেশসমূহ উন্নত দেশে পণ্যের বাজারে পরিণত হচ্ছে। ধনী দেশগুলো বাণিজ্য উদারীকরণের নামে বিশ্বজুড়ে চালাচ্ছে লুণ্ঠন ও শোষণ।
২) ধন বৈষম্য বৃদ্ধি:- বিশ্বায়ন ব্যবস্থা উন্নত ও অনুন্নত দেশের মধ্যে ধন বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বায়নের সুফল গুলো মূলত উন্নত দেশগুলোয় ভোগ করছে। এর ফলে উন্নত ও ধনী দেশগুলো র সাথে অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোর ব্যবধান ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৩) দেশীয় শিল্পের বিকাশ ব্যাহত:- বিশ্বায়নের প্রভাবে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। উন্নত দেশে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী অবাধে অনুন্নত দেশের বাজারে প্রবেশ করছে। এর ফলে অনন্যা তো দেশের শিল্পের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
Read More :- বিশ্বায়নের পক্ষে কিছু যুক্তি এবং ইতিবাচক দিক।
৪) পুঁজিবাদের সম্প্রসারণ:- বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় পশ্চিমের উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো ক্রমশই তৃতীয় বিশ্বের বাজারে আধিপত্য বিস্তার করছে। বস্তুত বিশ্বায়ন হলো পুঁজিবাদের একটি প্রসারিত রূপ। বিশ্বায়নের মাধ্যমে পুঁজিবাদ তার শোষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
৫) বহুজাতিক কোম্পানির প্রাধান্য:- বিশ্বায়নের সুযোগ নিয়ে উন্নত দেশ কেন্দ্রিক বহুজাতিক কোম্পানি সমূহ বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ প্রধান্য বিস্তার করছে। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ বিপন্ন হচ্ছে।
৬) বাণিজ্যিক ভারসাম্যের উপর বিরূপ প্রভাব:- বিশ্বায়নের অন্যতম পূর্ব শর্ত হলো বাণিজ্য উদারীকরণ। কিন্তু বাণিজ্য উদারীকরণের সুফল মূলত উন্নত দেশসমূহ ভোগ করছে। বিশ্বায়ন ব্যবস্থায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর আমদানি বাড়ছে কিন্তু রপ্তানি বাণিজ্যে উন্নত দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশসমূহের বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৭) মেধা পাচার:- বিশ্বায়নের বিপক্ষে অন্যতম যুক্তি হলো মেধা পাচার। বিশ্বায়নের কারণে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জনগণের মধ্য বিদেশ মুখিতা বাড়ছে। উন্নত জীবন যাপনের মোহে এসব দেশের মেধাবী জনগোষ্ঠী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশসমূহ ক্রমশ মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে।
৮) অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি:- বিশ্বায়নের বিপক্ষে অন্যতম যুক্তি হলো অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি। বর্তমান বিশ্বের একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংযুক্ত। পৃথিবীর কোথাও কোন অপরাধ সংগঠিত হলে তার প্রভাব অন্য দেশের উপরেও পড়ে। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাদকাসক্তি, সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণ, অবৈধ অস্ত্র পাচার প্রভৃতি অপরাধ আশঙ্কা জনক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৯) পরিবেশ বিপর্যয়:- বিশ্বায়নের বিপক্ষে অন্যতম যুক্তি হলো পরিবেশ বিপর্যয়। বিশ্বায়নের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এইডস, ফ্লু, ডেঙ্গু জ্বর, জন্ডিস প্রভৃতি মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে।
১০) সংস্কৃতিক আগ্রাসন:- বিশ্বায়নের বিপক্ষে অন্যতম যুক্তি হলো সাংস্কৃতিক অগ্রাসান। বিশ্বায়নের মাধ্যমে অবাধ তথ্য প্রবাহের যে ধারা প্রবাহিত হচ্ছে তার ফলে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিশ্বায়নের ফলে উন্নত দেশগুলোর সংস্কৃতিক অগ্রাসনে স্বল্পোন্নত দেশসমূহ তাদের নিজস্ব সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলছে এবং পশ্চিমা অপসংস্কৃতির শিকারে পরিণত হচ্ছে। এটি বিশ্বায়নের অন্যতম নেতিবাচক দিক।
Read More :- বিশ্বায়ন কি এবং বিশ্বায়নের কিছু বৈশিষ্ট্য।
উপসংহারে বলা যায়, বিশ্বায়নের পক্ষে যেমন যুক্তি রয়েছে তেমনি বিশ্বায়নের বিপক্ষে ও অনেক যুক্তি রয়েছে। বস্তুত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের বিপক্ষের যুক্তিগুলো অনেক বেশি জোরালো। এ কারণে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশ্বায়ন বিরোধী আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। তবে বর্তমানে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বায়নের ফলে দেশ এবং সমাজে কিছু খারাপ প্রভাব পড়লেও এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে বিশ্বায়ন থেকে দূরে থাকা বা এর সম্পূর্ণরূপে বিরোধিতা করা অসম্ভব। আমরা জানি সব কিছুরই কিছু ভালো দিক এবং খারাপ দিক আছে ঠিক তেমনি বিশ্বায়নের কিছু ভালো দিক এবং কিছু খারাপ দিক আছে তবে বিশ্বায়নের ফলে খারাপের চেয়ে ভালো দিকটাই বেশি তাই সমগ্র বিশ্বে বিশ্বায়নের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পৃথিবী আরো বিশ্বায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
বিশ্বায়ন সব সময় সবার পক্ষে সমান ভাবে উপকার বয়ে আনে না। কারন আমরা বর্তমান সময় দেখতে পাই যে বিশ্বায়নের ফলে সকল দেশ কমবেশি লাভবান হলেও এর মূল ফায়দা উন্নত দেশগুলো তুলে নেয়। উন্নত দেশগুলো তাদের আবিষ্কৃত বিভিন্ন প্রযুক্তি দিয়ে পুরো পৃথিবীর উপর রাজ করছে। তাদের সংস্কৃতি কালচার সকল দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাদের উন্নতি প্রযুক্তি বিভিন্ন অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মার্কেট ধরে রেখেছে সেখানে দেশীয় প্রযুক্তি তাদের সমান হয়ে উঠতে পারছে না যার কারণে দেশীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর লস হচ্ছে। বিশ্বায়নের ফলে উন্নত দেশের প্রোডাক্টগুলোর সাথে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রোডাক্ট সমপরিমাণ সেবা দিতে পারে না যার কারণে উন্নত দেশগুলো এর সুবিধা ভোগ করে এবং উন্নত দেশগুলোর তৈরি করা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও তাদের নির্দেশেই চলে। আমাদের এটা মানতে হবে যে বর্তমান যুগে বিশ্বায়নের গুরুত্ব অপরিসীম সুতরাং এটাকে এড়িয়ে চলা বা খারাপ ভাবে দেখার কোন উপায় নেই। তবে আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে বিশ্বায়নের ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে উন্নত দেশগুলো বিশেষ করে বড় সুপার পাওয়ার গুলো যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বায়নের ফলে তাদের প্রভাব অন্য দেশগুলোর উপর প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে যার ফলে একটি দেশের নিজস্ব ব্যাপারেও তারা নাক গলাতে পারে। সুতরাং বিশ্বায়নের যেমন ভালো দিক আছে তেমনি এর ক্ষতিও আছে। আমাদের এটি মাথায় রাখতে হবে যে বিশ্বায়নের সুফল যেন সব দেশেই ভোগ করে এবং উন্নত দেশগুলো যেন এর বেশি ফায়দা না নিতে পারে। নিজের দেশী প্রোডাক্টকে জনগণের গুরুত্ব দেওয়া বেশি জরুরী কারণ উন্নত দেশের প্রোডাক্ট গুলো যেভাবে আমাদের দেশীয় পণ্যের বাজার নষ্ট করছে তার ফলে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটি একটি দেশের অর্থনীতির জন্য খারাপ সংকেত সুতরাং আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলো সরকারকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।
0 Comments