অর্থশাস্ত্রে অর্থায়ন ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য সর্বাগ্রে যে উপাদানটির প্রয়োজন হয় তা হল অর্থ। বস্তুত অর্থ ছাড়া কোন উৎপাদন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যায় না। অর্থায়নই হলো কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জীবনীশক্তি। তাই অর্থায়ন সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা বিশেষ প্রয়োজন। অর্থায়ন ধারণাটি সংকীর্ণ ও ব্যাপক উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়। সংকীর্ণ অর্থে অর্থায়ন বলতে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তহবিল সংগ্রহ করাকে বোঝায়। ব্যাপক অর্থে অর্থায়ন বা অর্থসংস্থান বলতে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং সংগৃহীত অর্থের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যবালিকে বোঝায়।
অর্থায়ন বলতে অর্থ সংগ্রহ সংক্রান্ত পরিকল্পনা, সহজ শর্তে বা লাভজনকভাবে অর্থ সংগ্রহ। সংগৃহীত অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার ইত্যাদি বিষয় সমূহকে বোঝায়। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সরকারের আর্থিক গতিশীলতা বৃদ্ধিতে বা যেকোনো উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ ও এর যথাযথ ব্যবহার। অর্থায়ন নিন্মোক্ত কার্যাবলী সম্পাদনে ভূমিকা পালন করে।
১) অর্থসংগ্রহের পরিকল্পনা :- অর্থায়নের প্রথম এবং প্রধান কাজ হল অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনা করা।
২) অর্থসংগ্রহের তুলনা করা :- অর্থ বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা যায়। তবে প্রত্যেকটি অর্থ সংগ্রহের উৎসের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে সহজ শর্তে ও লাভজনক উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করা অর্থায়নের অন্যতম কাজ।
৩) সহজশর্তে অর্থসংগ্রহ :- অর্থ সংগ্রহ যেমন অর্থায়নের কাজ তেমনি অর্থ ব্যয় বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মুনাফা প্রাপ্তির দিকটি লক্ষ্য এবং রক্ষা ও অর্থায়নের কাজ।
৪) অর্থব্যয়ের নীতিমালা :- অর্থ ব্যয়ের বিভিন্ন নীতিমালা তৈরি করে সেই ভিত্তিতে অর্থ ব্যয় করা অর্থায়নের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
Read More :- মুদ্রাস্ফীতি কিভাবে একটি দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে পারে।
৫) তহবিলের ব্যবহার :- তহবিল সংগ্রহের পর অর্থায়নের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল ব্যবসায় বিনিয়োগ ঝুঁকির বিষয়টি স্মরণ রেখে উৎপাদন খরচ সর্বনিম্নকরণের মাধ্যমে গুণাগত মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করে মুনাফা সর্বাধিক করা।
৬) ফলাফল নির্ণয় :- বিনিয়োগ প্রকল্পের ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও অর্থায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিনিয়োগের প্রকল্প হতে কি পরিমান লাভ অর্জিত হলো, বর্তমান আর্থিক অবস্থা কেমন, ক্ষতি হলে কিভাবে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া হবে এসব পর্যালোচনা করা হয়।
এছাড়াও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নগদ তহবিল, আর্থিক দলিলপত্র, ভাউচার, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র সংরক্ষণ, প্রকল্পের ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কম খরচে সর্বাধিক উপযোগিতাসম্পন্ন পন্য সেবা উৎপাদন, অর্থায়নের সাথে জড়িত সকল প্রকার সম্পর্ক সুশৃংখলভাবে ব্যবস্থাপনা করা, বাজেট প্রণয়ন, হিসাবরক্ষণ, কর পরিকল্পনা, বিমাকরণ, কার্তিক প্রতিবেদন প্রস্তুতকরণ, ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ, শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি ও কর্মচারীদের কল্যাণে দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ প্রভৃতি কার্য সম্পাদনে অর্থায়নের গুরুত্ব রয়েছে।
অর্থায়নকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায় সরকারি অর্থায়ন এবং বেসরকারি অর্থায়ন।
১) সরকারি অর্থায়ন :- দেশের সরকার কর্তৃক সংগ্রহীত অর্থায়নকে সরকারি অর্থায়ন বলে। সরকার দেশি বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। সরকার সাধারণত জনগণের কল্যাণে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে। যেমন - সামাজিক কল্যাণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, পল্লী উন্নয়ন, শিক্ষা বিস্তার, দারিদ্র বিমোচন ইত্যাদি সরকারের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যে অর্থায়ন করা হয় তাকে সরকারি অর্থায়ন বলে। এই অর্থসংস্থানের উৎস অভ্যন্তরীণীয় বা বাহিক্য অথবা উভয় হতে পারে। অভ্যন্তরীণীয় উৎসের মধ্যে অভ্যন্তরীণীয় সঞ্চয়, কর, শুল্ক ও অ-কর রাজস্ব প্রকৃতি উল্লেখযোগ্য। বাহিক্য উৎস বলতে বিভিন্ন দেশের সাহায্য সংস্থা আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রকৃতির কাজ থেকে ঋণ, ঋণদান ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করাকে বোঝায়।
২) বেসরকারি অর্থায়ন :- ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নই হল বেসরকারি অর্থায়ন। সরকারি অর্থায়ন ব্যতীত অন্য যে কোন প্রকার অর্থায়ন কে বেসরকারি অর্থায়ন বলে। বেসরকারি অর্থায়ন আবার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে যেমন:-
ক) ব্যক্তিগত অর্থায়ন :- কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তার দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের জন্য যে অর্থায়ন করে থাকে তাকে ব্যক্তিগত অর্থায়ন বলে। এ অর্থ সাধারণত সে তার ব্যক্তিগত আয়, পারিবারিক আয়, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং প্রয়োজনে ব্যাংক ও অনন্য প্রতিষ্ঠান হতে ঋণ গ্রহণ করে এরূপ অর্থায়ন করেন।
খ) ব্যবসায় অর্থায়ন :- ব্যবসায়িক প্রয়োজনীয় কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে ব্যবসায় অর্থায়ন বলা হয়। সাধারণত মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যে অর্থায়ন করা হয় তাকে ব্যবসায়ী অর্থায়ন বলে।
গ) অব্যবসায় অর্থায়ন :- কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা অব্যবসায়িক কাজের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও ব্যবহার করে থাকে তাকে অব্যবসায় অর্থায়ন বলা হয়। যেমন - স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল ইত্যাদি।
ঘ) আন্তর্জাতিক অর্থায়ন :- সাধারণত কোন দেশের আমদানি রপ্তানির জন্য যে অর্থায়ন ব্যয় হয় তাকে আন্তর্জাতিক অর্থায়ন বলে। যেমন - বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বিদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি আমদানি করে।
Read More :- বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য।
অর্থায়নের ব্যাপক সুবিধা রয়েছে, বর্তমান সময়ে উৎপাদনশীল কোন কিছু করতে হলে অবশ্যই অর্থ বা শ্রমের দরকার হবে। অর্থায়ন ছাড়া একজনের ব্যক্তিগত জীবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সরকার কোন কিছুই ঠিকভাবে চলো সম্ভব নয়। সুতরাং অর্থনীতিতে অর্থায়নের গুরুত্ব অপরিসীম।
0 Comments