মুদ্রাস্ফীতি যে একটি দেশের জন্য কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটি আমরা ভেনেজুয়েলার দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতির হার বর্তমানে ২০০% এর ও বেশি। দেশটিতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় এবং গণতন্ত্র না থাকে দেশটির অবস্থা আজ ভয়ংকর। দেশটির অধিকাংশ জনসংখ্যা খাদ্য, দ্রব্য, বস্ত্র এবং চিকিৎসার মত সাধারণ মৌলিক অধিকার গুলো থেকে বঞ্চিত। ২০১৪ সালে যখন গণতন্ত্রের দাবিতে সেখানকার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং সরকার কঠোরভাবে সেটি প্রতিরোধ করে ঠিক তখন থেকেই ভেনেজুয়েলার অর্থনীতির দুর্দশা শুরু হয় এবং সেটি এখনো চলমান।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ভেনেজুয়েলার অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙে পড়েছে। দেশটির মুদ্রার মান আর নেই বললেই চলে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে এবং দেশটির বিভিন্ন খাতে বিশাল সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। নিম্নে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১) মুদ্রার মান :- দেশটিতে অকল্পনীয় হারে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার কারণে দেশটির মুদ্রার মান এতটাই কমে গিয়েছে যে সেটি সেই দেশের জনগণ নিজেরাই আর ব্যবহার করতে চায় না। এমনকি এমন ঘটনাও ঘটেছে যে সামান্য দামি কিছু জিনিস কেনার জন্য বড় ধরনের কোন প্যাকেট ভর্তি মুদ্রা নিয়ে যেতে হয়। এটি থেকে বোঝা যায় দেশটির মুদ্রার মান এর কি অবস্থা। দেশটির মানুষজন তাদের নিজস্ব মুদ্রার বদলে শক্তিশালী মুদ্রা গুলো যেমন ডলার, ইউরো ইত্যাদি বিভিন্ন মুদ্রা ব্যবহার করা শুরু করেছে। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতির ফলে মুদ্রার মান কমে যায় কিন্তু ভয়ংকর মুদ্রাস্ফীতির ফলে মুদ্রার মান প্রায় নষ্ট হয়ে যায়।
২) দ্রব্যমূল্যের দাম :- দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতির ফলে দ্রব্যমূল্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। এমনও পরিস্থিতি দেখে গিয়েছে যে দেশটির জনগণ কুকুর বিড়াল এবং অন্য মানুষের ফেলে দেওয়া খাবার গুলি পর্যন্ত কুড়িয়ে খাচ্ছে। প্রতিদিনই সেখানে খাদ্য দ্রব্যের বাজার মূল্য পরিবর্তন হতে থাকে যার ফলে জনসাধারণকে অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। মুদ্রাস্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্যের দাম এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে অধিকাংশ জনগণের কাছে সামান্য তিন বেলা খাওয়ার জন্য পর্যন্ত মুদ্রা নেই।
৩) বিনিয়োগ :- দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হওয়ার পর থেকে বিনিয়োগ প্রতিবছর কমতেই আছে। দেশটির অবস্থা এতটাই খারাপ যে, দেশের বড় বড় শিল্পপতিরা দেশ থেকে চলে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন উপায় খুঁজছে এবং অনেকেই ইতিমধ্যেই দেশ থেকে চলে গিয়েছে। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরীণীয় বিনিয়োগের ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দেশটির সরকারের উপর প্রচুর স্যাংশন থাকার কারণে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীগণ দেশটিতে সঠিক উপায় বিনিয়োগ করতে পারে না। দেশটির সরকার ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অর্থনীতির অবস্থা অত্যন্ত বাজে হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীগণ এই দেশটিতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখায় না। সুতরাং এর ফলে দেশের উন্নয়ন চরমভাবে বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে।
Read More :- অর্থায়ন এবং এর সুবিধা গুলো কি কি?
উন্নয়নমূলক প্রকল্প :- দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অস্থিরতা এবং গৃহযুদ্ধের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণে উন্নয়নমূলক প্রকল্প গুলো আটকে আছে। বর্তমানে দেশটির নিজস্ব অর্থনীতি প্রচুর দুর্বল হওয়ার কারণে উন্নয়নমূলক প্রকল্প গুলোর পেছনে অর্থ ব্যয় করার মত সামর্থ্য সরকারের এখন নেই এবং দেশটির উপর প্রচুর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে বৈদেশিক লোন অথবা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা থেকে লোন পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এই উন্নয়নমূলক প্রকল্প গুলো না হওয়ার কারণে দেশটির ভবিষ্যৎ হুমকির সম্মুখীন।
ব্যাংকিং খাত :- দেশটিতে অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি হওয়ার কারণে ব্যাংকিং খাতের মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়েছে। মুদ্রার মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বারবার হস্তক্ষেপ করতে হয়। অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতির কারণে ব্যাংকের সুদের হার নিয়মিত উঠানামা করে যার ফলে সেখানে টাকা রাখা কেউ সুরক্ষিত মনে করে না। এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞার কারণে বহির্বিশ্বের সাথে ব্যাংকগুলোর লেনদেন অনেকাংশই বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে যার ফলে দেশটির ব্যাংকিং সেক্টর প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
Read More :- মুদ্রাস্ফীতি কিভাবে একটি দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে পারে।
রাজনৈতিক সমস্যা এবং মুদ্রাস্ফীতির ভয়ংকর প্রকোপে দেশটির অর্থনীতি আজ ধ্বংসের পথে। মুদ্রাস্ফীতির সবচেয়ে ভয়ংকর প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উপর। সাধারণ মানুষের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাদের তাদের সঞ্চয়কৃত মুদ্রার মান কমতে থাকে এবং বাজারে দ্রব্য সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পেতে থাকে ফলে জনগণের মধ্য অসন্তোষ এবং ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট আয়ের মানুষরাই নয় বরং বড় বড় শিল্পপতি সহ বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোরও বিভিন্ন ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। সুতরাং একটি দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের প্রধান লক্ষ্য গুলোর একটি হওয়া উচিত। অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি একটি দেশের জনগণের জন্য কখনোই কল্যাণকর নয়।
0 Comments