অর্থায়নের উৎস হিসেবে এনজিওর ভূমিকা।

তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় এনজিও একটি বহুল আলোচিত নাম। গ্রামীন দরিদ্র বিমোচনে এনজিওর ভূমিকা নিয়ে অর্থনীতিবিদ, পরিকল্পনাবিদ, উন্নয়ন গবেষক এবং এনজিও সংগঠকদের মধ্য নানা মতামত বিদ্যমান। তবে মতের ভিন্নতা সত্ত্বেও বাংলাদেশী গ্রামীণ দরিদ্রতা বিমোচনে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, অতিরিক্ত আয়ের সংস্থান এবং গ্রামীণ দরিদ্র ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা উন্নত করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা সমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।


অর্থায়নের উৎস হিসেবে এনজিওর ভূমিকা।


সম্প্রতিকালে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা দারিদ্র্য মোচনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। দারিদ্র মোচনের জন্য কাজ করছে জাতীয় পরিচয় এমন এনজিও এর সংখ্যা বাংলাদেশে ৪০০ এর বেশি। অবশ্য স্থানীয় এনজিওগুলোকে হিসাবের মধ্যে ধরলে এদের সংখ্যা দশ হাজার এরও বেশি হবে। এসব এনজিওদের  মধ্যে ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, কেয়ার, আশা, প্রশিকা, এভাবে, নিজেরা করি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, গণ উন্নয়ন কেন্দ্র, গণ উন্নয়ন প্রচেষ্টা, জাগরণী চক্র, উত্তরণ সংঘ, রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টার প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব দেশি বিদেশি এনজিও গ্রামীণ দারিদ্র বিমোচন প্রচেষ্টায় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনে এনজিওদের ভূমিকা সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।

১) বাংলাদেশে কর্মরত এনজিওগুলোর প্রধান কাজ হল গ্রামের বিত্তহীন জনগোষ্ঠীর মধ্য ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করা এবং এর মাধ্যমে তাদের জন্য কর্মসমস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা । গ্রামীণ ব্যাংক ও পল্লী কর্ম ফাউন্ডেশন সহ বিভিন্ন এনজিও ২০০১ সালের জুন মাস পযন্ত ১৪,৩৯৮.৩২ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে । এভাবে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের মাধ্যমে আত্ম কর্মসমস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে গ্রামীণ দারিদ্র নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ।


Read More :- অর্থায়নের উৎস হিসেবে এনজিও ও ব্যাংকের গুরুত্ব।


২) বাংলাদেশে গ্রামে বসবাসকারী অধিকাংশ লোকই অশিক্ষিত এবং কুশমস্কারআচ্ছন্ন । এই অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষার প্রয়োজন । এনজিওগুলো দেশের প্রচলিত পাঠ্যসূচি অনুযায়ী শিশুদেরকে শিক্ষা প্রদান করা ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা কাযক্রমের মাধ্যমে বয়ষ্কদেরকে শিক্ষা দান করে থাকে । গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা প্রদান করার ক্ষেত্রে এনজিও গুলোর গুরুত্ব অপরিসীম ।

৩) গ্রাম অঞ্চলে স্বাস্থ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন বিভিন্ন এনজিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই এখনো উন্নত চিকিস্সা ব্যবস্থার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। পরিবার পরিকল্পনা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্র সম্পর্কেও তারা যথেষ্ট সচেতন নয় । এ ক্ষেত্রে এনজিও গুলো গ্রামের দরিদ্র জনগণকে বিশেষকরে শিশুদেরকে টিকাদানসহ প্রাথিমিক স্বাস্থ পরিচর্চা, পুষ্টি বিষয়ে জ্ঞানদান, সেনেটারি ল্যাট্রিন নির্মাণ প্রভিতি কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামীণ স্বাস্থ ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে । তাছাড়া, পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে জনগণকে অধিকতর সচেতন করে তোলার মাধ্যমে জনসংখা নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ।

৪) বাংলাদেশে কর্মরত এনজিওগুলোর অন্যতম প্রধান কাজ হলো ত্রাণ ও পূর্ণবাসন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ । বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস প্রভিতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয় । এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় এনজিওগুলো ব্যাপক ত্রাণ ও পূর্ণবাসন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭০ সালের প্রলয়কারী ঘূর্ণিঝড়ের সময় বিভিন্ন দেশি - বিদেশী এনজিও ত্রাণ ও পূর্ণবাসন কার্যক্রমে ব্যাপক অংশগ্রহণ করে। বস্তুত বাংলাদেশের যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দেশি - বিদেশী এনজিও গুলো ত্রাণ ও পূর্ণবাসন কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

৫) কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রেও এনজিও সুমুহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, সেচ যন্ত্রপাতি ক্রয়, কৃষির বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ, বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে সার, বীজ সরবরাহ প্রভিতি  কার্যক্রমের মাধ্যমে এনজিও গুলো কৃষি উন্নয়নে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে।

৬) বাংলাদেশে গ্রামীণ কুটির শিল্পের উন্নয়নে এনজিওগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্রামঅঞ্চলে নতুন কুটির শিল্প স্থাপন, পুরাতন কুটির শিল্প সম্পসারণ, কুটির শিল্পের কাঁচামাল যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরবরাহ এবং দরিদ্র কুটির শিল্পীদের ঋণদানের মাধ্যমে এনজিওগুলো কুটির শিল্পের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

৭) বাংলাদেশে কর্মরত এনজিওগুলো গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঋণ প্রদান এবং এসব ঋণের তদারকির মাধ্যমে উদ্পাদনমুখী কাজে নিয়োজিত করে তাদের আয় ও সঞ্চয় বৃদ্ধিতে সময়তা করে।


Read More :- ভেনেজুয়েলায় মুদ্রাস্ফীতির ভয়ংকর প্রভাব।


৮) বাংলাদেশে কর্মরত এনজিওগুলো গ্রামের দরিদ্র এবং অশিক্ষিত জনগণকে তাদের নিজেদের ভাগ্যউন্নয়নে নিজেদের সচেষ্ট হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দেয়, মহিলাদের অধিকার সম্পর্কে আইনগত পরামশ প্রদান করে। গ্রামের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতন সৃষ্টি প্রভিতি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে।

এভাবে দেশি এবং বিদেশী এনজিও গুলো এনজিওগুলো আমাদের দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ১৯৮৩ সালে বিশেষায়িত প্রতিষ্টান হিসাবে গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়।গ্রামীণ ব্যাঙ্ক উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম, দারিদ্র বিমোচনের নতুন মডেল হিসাবে স্বীকৃতি পায়, যা বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়। ব্যাংকটি মূলত গ্রাম অঞ্চলের দরিদ্র মহিলাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের কাজ করছে। ডিসেম্বর ২০১৭ পযন্ত ২৫৬৮ টি শাখার মাধ্যমে ৬৪ জেলার ৪৭৯ উপজেলার ৮১,৪০১ টি গ্রামে ৮৯,৩৫ লক্ষ সদস্যের মধ্যে এই কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে। সদস্যদের ৯৭ শতাংশই মহিলা। ব্যাংকটি মার্চ ২০১৮ পযন্ত মোট ১,৬৯,৬৪৭.১২ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে।

Post a Comment

0 Comments