পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশের অর্থনীতিতেই মুদ্রাস্ফীতি কম-বেশি বিরাজমান। তবে উন্নত দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতির হার সবসময় কমই থাকে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতির হার মাঝামাঝি এবং অনুন্নত দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতির হার একটু বেশিই থাকে। তবে অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি কোন একটি দেশে অর্থনীতির জন্য ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। নিচে এই বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
কোন একটি দেশে যদি অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় তাহলে দেশটির অর্থনীতি বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন নয় যেমন:-
১) মুদ্রার মান কমে যাওয়া :- অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতির ফলে মুদ্রার মান কমে যায়। মুদ্রার অংক সেই পরিমাণ থাকলেও সেই সমপরিমাণ মুদ্রা দিয়ে আগে একটি জিনিস যে দামে কেনা যেত এখন সেটির জন্য আরও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় সেই কারণে দেশের জনগণের উপর এর খারাপ প্রভাব পড়ে। একেই বলা হয় মুদ্রার মান কমে যাওয়া।
২) মুদ্রাস্ফীতির ফলে দ্রব্য পণ্যের দাম বেড়ে যায় :- যেমন, একবছর আগে ১ কেজি আলুর দাম ৫০ টাকা ছিল কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির ফলে সেই এক কেজি আলুর দাম এখন ৬০ টাকা। এইভাবে মুদ্রাস্ফীতি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয় যার ফলে দেশের জনগণের সমপরিমাণ জিনিস কিনতে অধিক ব্যয় করতে হয়।
Read More :- বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য।
৩) নির্দিষ্ট বেতনের চাকরিজীবীদের ভোগান্তি :- মুদ্রাস্ফীতি নির্দিষ্ট বেতনের চাকরিজীবীদের উপর খুবই বাজে প্রভাব ফেলে যেমন, একজনের বেতন ২৫ হাজার টাকা কিন্তু এক বছর পর সেই চাকরিজীবীর বেতন না বাড়লেও জিনিসপত্রের দাম কি প্রতিবছর বাড়তেই থাকে যার ফলে সেই চাকরিজীবী ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং তার জীবনযাত্রার মানের উপর খুবই খারাপ প্রভাব ফেলে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ সেক্টরের চাকরিজীবীদের প্রতি বছর বেতন বৃদ্ধি পেতে দেখা যায় না যার ফলে মুদ্রাস্ফীতি এই নির্দিষ্ট আয়ের মানুষগুলোর জন্য বহু ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে।
মুদ্রাস্ফীতির ফলে এই ধরনের সমস্যা গুলো সৃষ্টি হয় কিন্তু যখন অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি হয় তখন বহু ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। আমরা তুরস্কের উদাহরণের মাধ্যমে বুঝতে পারব যে একটি দেশে অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে।
তুরস্কের অর্থনীতি :- বর্তমানে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে তুরস্কের মুদ্রাস্ফীতির হার ৬০ শতাংশ যেটি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। যার ফলে দেশটিতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে যেমন, তুরস্কের মুদ্রার নাম লিরা। যেটি ২০২৩ সালের মার্চ মাসে ১ মার্কিন ডলার সমান ১৯ লিরা ছিল সেটি এক বছর পর ২০২৪ সালে মার্চ মাসে ৩২ লিরা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তুরস্কের লিরা এক সময় ইউরোপের মজবুত মুদ্রা গুলোর মধ্যে একটি ছিল কিন্তু বর্তমানে এর অবস্থা খুবই করুণ। ২০২১ সাল থেকেই মূলত এর ব্যাপক দর পতন হওয়া শুরু করে, ২০২১ সালে ১ মার্কিন ডলার সমান ৮ লিরা ছিল সেটি বর্তমানে ৩২ লিরা হয়েছে। বিগত তিন বছরের এই ভয়ংকর দর পতনের ফলে তুরস্কের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটির প্রত্যেকটি সেক্টরের মেরুদন্ড অনেকটাই ভেঙ্গে গিয়েছে। রাজনৈতিক সহ বিভিন্ন কারণে দেশের অর্থনীতি ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে দেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ সহ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং যার ফলে একটি দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর দাম বর্তমানে আকাশ ছুঁয়েছে কিন্তু সেই অনুযায়ী বেতন বৃদ্ধি না পাওয়ায় সাধারণ দ্রব্য সামগ্রীগুলো কেনাও মানুষের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। তুরস্কে গত এক বছরে প্রত্যেকটি জিনিসের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে কিন্তু নির্দিষ্ট কর্মজীবী মানুষের বেতন খুব একটি বাড়েনি যার ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সুতরাং তুরস্কের এই অবস্থা থেকে আমরা অনুমান করতে পারি অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি একটি দেশের জন্য কতটা ভয়ংকর হতে পারে। এই ধরনের অর্থনৈতিক সংকট থেকে বাঁচার জন্য একটি দেশের রাজনৈতিক অবস্থা অবশ্যই ঠিক রাখার চেষ্টা করতে হবে এবং অবশ্যই গণতন্ত্র বজায় রাখতে হবে। অর্থনীতি ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং দেশের রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হবে। অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপানো বন্ধ করতে হবে কারণ অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপানোর ফলে দেশের মুদ্রার পরিমাণ অত্যাধিক বৃদ্ধি পায় এবং যার কারণে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়। দেশে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে পণ্য মজুদ করে পণ্যের দাম বৃদ্ধি না করতে পারে। দেশে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে যাতে বিনিয়োগের জন্য একটি সুরক্ষিত জায়গা বলে মনে হয়। এভাবে অর্থনীতিকে সঠিকভাবে ম্যানেজ করতে পারলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং জনগণের জীবনযাত্রার মানের উপর খুব বেশি প্রভাব পড়বে না তাহলে দেশে স্থিতিশীলতা এবং শান্তি বজায় থাকবে।
Read More :- ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নের উৎসসমূহ।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা এটাই বুঝলাম যে একটি দেশে অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি কতটা ভয়ংকর ফলাফল বয়ে আনতে পারে এবং এই মুদ্রাস্ফীতি থেকে দেশকে বাঁচানোর কিছু উপায় নিয়েও উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
0 Comments